Type Here to Get Search Results !

বাংলায় বাউল গান-চর্চার ঐতিহ্য দীর্ঘকালের পর্ব -০৫

Top Post Ad

 

বাংলায় বাউল গান-চর্চার ঐতিহ্য দীর্ঘকালের পর্ব -০৫

এই আত্মকথনের সময় সোহারাব হোসেনের বয়স পঞ্চাশ। জীবনের হাটে কেনা-বেচা-লেনা-দেনা একেবারে কম হয়নি। তীক্ষনধী আর সংবেদনশীলতার কারণে অভিজ্ঞতা যেমন বেড়েছে, তেমনি গভীর হয়েছে বোধি। চৈতন্যের অন্তস্তলে অনুধাবন করেছেন লোভ-লালসা-হিংসা-বিদ্বেষে পূর্ণ যে-টেনশন বা আততিভরা জীবন আমরা যাপন করি, তা যদি একটা সভ্যতা হয় তবে বাউলের জীবনযাপন ও তার তত্ত্বদর্শন পালটা আরেকটি সভ্যতা। এই সভ্যতায় প্রথম সভ্যতার দুঃখ ও অশামিত্মর মূলীভূত কারণগুলো অবদমিত থাকে, বলা ভালো তাদের মেরে ফেলা হয়। বাউল একেই বলেন জ্যান্তে-মরা।
অথচ, সোহারাব লক্ষ করেছেন, বাউল-ফকিরদের সম্পর্কে সমাজে সাধারণভাবে নেতিবাচক ধারণা প্রচলিত রয়েছে, যা তাঁর বিবেচনায় বিভ্রম সৃষ্টিকারী। একদল মনে করেন গেরুয়াধারী তালিতাপ্পি মারা চোগাচাপকান-পরা বাবরিচুলো গৃহবিবাগি একতারা বাজিয়ে গান গেয়ে বেড়ানো মানুষেরাই বাউল। আরেক দল বাউল বলতে বোঝেন মদ-ভাং-গাঁজাসেবী, যৌন কদাচারে লিপ্ত,
গান-বাজনায় মত্ত আখড়াবাসীদের। তৃতীয় অন্য একটি শ্রেণির কথাও তিনি বলেছেন। তাঁরা বাউল-গবেষক হিসেবে পরিচিত। এঁদের কারো কারো কাছে বাউল-সঙ্গ ও গবেষণা স্ট্যাটাস-সিম্বলের নামান্তর। তাঁরা বাউলপ্রসঙ্গ নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করেন, তার দর্শনকে গ্রহণ করেন না। বরং উলটো কাজ করেন।
ওপরের শেষ বাক্যদুটি বর্তমান আলোচকের অভিমত। তিনি এমন একাধিক গবেষককে খুব কাছ থেকে দেখেছেন। লালনের গানের ভাষায় দরগাতলায় শিরনি খাওয়ার লোভতাদের মধ্যে প্রবলভাবেই দেখা গেছে। সোহারাবের বিবেচনায় এরা এবং প্রথমোক্ত দুটি দল বাউল-ফকিরদের সম্পর্কে ভুল ধারণা পোষণ করে
সমাজ-মনেও বিভ্রামিত্মর জন্ম দেন। এই ভুল ধারণা সৃষ্টির পেছনে ভেকধারী কিছু কথিত বাউলেরও হয়তো ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু প্রকৃত বাউলের উদ্দেশ্য হচ্ছে লালন ফকির যেমনটি বলেছেন – ‘সত্য বল সুপথে চল ওরে আমার মন।অভিজ্ঞতায় এই সত্যলাভ করেছেন বলেই সোহারাব নিজের জীবনের সঙ্গে তাকে অন্বিত করে নিয়েছিলেন। কেবল ব্যক্তিজীবনে নয়, তাঁর শিল্পীজীবনেও এর প্রভাব এতটা আমূল ছিল যে, প্রথম উপন্যাস মহারণে (২০০৩) কেন্দ্রীয় থিম হিসেবে বাউলতত্ত্ব ও সত্যকেই গ্রহণ করেছিলেন। এই উপন্যাসে বাউলতত্ত্বের সঙ্গে মার্কসতত্ত্বকে মেলাবার এক অভিনব ও সাহসী চেষ্টা দেখা যায়। এ যেন দুই ভিন্ন প্রকৃতির বস্ত্তবাদের মিলন-প্রয়াস। কিন্তু তাঁর শিল্পীসত্তা এখানেই সন্তুষ্ট থাকতে পারেনি। মহারণ রচনা শুরুর দেড় যুগেরও বেশি পর ২০১৬ সালে লেখেন, তাঁর নিজের কথায়, ‘বাউলতত্ত্ব ও বাউল-ব্যাকরণের সামগ্রিক রূপ-মহারূপসর্বস্ব উপন্যাস আরশি মানুষএছাড়া অনেকগুলো ছোটগল্পের বিষয়ের মধ্যেও বাউল-দর্শন জায়গা জুড়েছে।
আরশি মানুষ রচনার আগের বছর সোহারাব লিখেন সহজ বাউল, যদিও সেটি গ্রন্থরূপে প্রকাশিত হয় পরে। মুখ-কথানামে ভূমিকায় বইটি লেখার পশ্চাৎপট হিসেবে জানিয়েছেন,
বন্ধু-পরিজন-ছাত্রসমাজ কিংবা পরিচিত শিক্ষক-অধ্যাপক-অনুসন্ধিৎসু গবেষক-মহলে বাউল নিয়ে বরাবরই প্রবল আগ্রহ ও কৌতূহল লক্ষ করেছি। বিভিন্ন স্থানে বাউল-সংক্রান্ত কিছু ক্লাস ও সেমিনার করার পর প্রাসঙ্গিক মহলকে বাউল-তত্ত্বসত্য ও বাউল গান সম্পর্কিত খুব স্পষ্ট আলোচনা-সমন্বিত বই খুঁজতে দেখেছি। কথা বলে বুঝেছি তাদের চাহিদা মূলত বাউল-সম্পর্কিত একটি হ্যান্ডবুকের। কৌতূহলী সমাজের এই অন্বেষণের প্রতিক্রিয়ায়, বাউল কী-কেন-কীরূপ তার একটা হ্যান্ডবুক হিসেবে, ‘সহজ বাউলগ্রন্থটিকে প্রস্ত্তত করতে চেয়েছি।
বইটি লেখার কারণ যা-ই হোক, আমাদের বিবেচনায় মহারণ, আরশি মানুষ ও সহজ বাউল পরস্পর পরিপূরক তিনটি বই। প্রথম দুটি বাউল দর্শনের শিল্পধর্মী রসরূপ আর তৃতীয়টি তথ্য ও ব্যাখ্যাধর্মী তত্ত্বরূপ।

Source: kaliokalam.com


Below Post Ad

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

Hollywood Movies